ঘুম হলো আমাদের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ, মস্তিষ্ক, চোখ, কান, ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের সবচেয়ে জটিল প্রক্রিয়াগুলো ঘুম ছাড়া ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। অনিদ্রার প্রথম লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়, চোখের নিচে কালো দাগ। এর কারণ হলো ঘুম কম হলে মানুষের ত্বকের কোষগুলো নিজেদের রিপেয়ার করতে পারে না। এ থেকে স্পষ্ট হয়, আমাদের ত্বকের সৌন্দর্য সরাসরি ঘুমের সঙ্গে জড়িত। ঘুমের আরেকটি প্রধান কাজ হলো চোখের মেরামত করা। তাই ঘুম ঠিকমতো না হলে পরদিন দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
পুরো ঘুম পরিচালিত হয় মস্তিষ্কের মাঝখান থেকে। প্রতিটি চোখের পেছনে অপটিক নার্ভ রয়েছে, যা চোখের অংশ এবং এরা সরাসরি মস্তিষ্কের পেছনে অকসিপিটাল লোবের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এর মানে হলো চোখ ও মস্তিষ্ক একসঙ্গে কাজ করে দেখতে ও চিন্তা করতে।
রেটিনার মাঝখানে অবস্থিত অপটিক নার্ভের অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি হলো ঘুমের সারকাডিয়ান রিদম রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব বডি ক্লক বা দেহঘড়ি আছে। আবার ঠিক তেমনি প্রকৃতির ও নিজস্ব আলো-আঁধারির সাইকেল আছে, যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
প্রকৃতির আলো-আঁধারির আবর্তন এবং মানুষের নিজস্ব দেহঘড়ি একসঙ্গে কাজ করে। চোখের অপটিক নার্ভ প্রাকৃতিক আলো- অন্ধকারের সিগন্যাল পেয়ে, অর্থাৎ বাইরে কি এখন আলো নাকি অন্ধকার, সেই তথ্য মস্তিষ্কের মাঝখানে অবস্থিত হাইপোথ্যালামাসে পাঠায়। এখান থেকে সুপ্রাসিয়াসমেটিক বার্তা নির্গত হয়। এর কাজ হলো ঘুমের সারকাডিয়ান সাইকেলকে ঠিকমতো চালিয়ে নেওয়া।
প্রকৃতিতে যখন অন্ধকার হয়, তখন থেকে মস্তিষ্কে সিগন্যাল পৌঁছানো শুরু হয় এবং মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। মেলাটোনিনকে বলা হয় ঘুমের হরমোন এবং এটি রাতের বেলা নিঃসরণ হয়, যা আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। দিনের আলোয় এই হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। জাগার পর থেকেই আবার ঘুমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। জেগে থাকলে শরীরে অ্যাডিনোসিন নিসৃত হয়। এই হরমোন আমাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন করে। এই হরমোন নিঃসরণ হতে থাকলে ১৬ ঘণ্টা পর শরীর ঘুমে এলিয়ে পড়ে। তার মানে হলো আমাদের মানবজীবন পুরোটাই ঘুমের সঙ্গে জড়িত।
আমাদের বডি ক্লক পেনিয়াল গ্ল্যান্ডের সঙ্গে জড়িত। পেনিয়াল গ্ল্যান্ড মস্তিষ্কের মাঝখানে অবস্থিত এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করে ৪টি হরমোনের মাধ্যমে। মেলাটোনিনের পাশাপাশি সেরাটনিন হলো মুড হরমোন, আঙ্গেনাইন ভেসোটসিন হলো প্রাকৃতিকভাবে ব্যথা নিরোধক এবং এই হরমোন ঘুমকে গভীর স্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আরেকটি হরমোন হলো এপিথেলামান, যা সারা দিন ধরে আসা সব তথ্যকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে মস্তিষ্ককে নতুন জিনিস শিখতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
প্রতিটি হরমোন নিঃসরণের পর অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস মস্তিষ্কে থেকে যায়, যা পরিষ্কার করার সময় হলো ঘুমের প্রথম ভাগ। এটাই আসলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, যা ক্লিঞ্জিংয়ের সময়। ঘুমের সময় চোখের পাতা বন্ধ থাকে। তবে চোখও মস্তিষ্কের সঙ্গে জড়িত, সেটা ঘুমের মধ্যে চোখের পাতা ক্রমাগত নড়তে থাকা থেকে বোঝা যায়। কারণ, আবার কিছুক্ষণ পর স্থির হয়ে যায়। পুরো ঘুমের প্রক্রিয়া ‘নন -র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ ও ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’—এই দুই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে চলতে থাকে।
আমরা সারা দিন যা করি, সেসব, অর্থাৎ সব স্মৃতি তা মস্তিষ্কের হিপ্পিক্যাম্পাসে সঞ্চিত থাকে। রাতে ঘুমের মধ্যে এসব স্মৃতি হিপ্পিক্যাম্পাস থেকে মস্তিষ্কের কর্টেক্সে পৌছাঁয়। ফলে একটি শিশু বা মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় মস্তিষ্কে সমান্তরালে সাফাইয়ের কাজও চলে।
এ সময় মস্তিষ্কের ফ্লুয়িডগুলো নিজের এবং নিউরনের আবর্জনা বের করে দেয়। সেই সঙ্গে বের করে দেয় নেতিবাচক সব অনুভূতি। অনিদ্রার কারণে এই পুরো চক্রের ব্যাঘাত ঘটে। ফলে মানুষের স্মৃতিভ্রম হয়। মানুষ ভুলে যেতে শুরু করে বা মস্তিষ্ক কোনো তথ্য ধরে রাখতে পারে না। তাই এই জেনারেশনের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো মনোযোগ দিতে না পারা।এ কারণে অনিদ্রায় আক্রান্ত মানুষ নেতিবাচক চিন্তা করে, শর্ট টেম্পারড হয়।
অন্যকে সন্দেহ করে। কথার খেই হারিয়ে ফেলে। ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার রোগে ভোগা শুরু করে। ঘুম ঠিক মতো না হওয়ায় জেটল্যাগের অনুভূতিতে ভুগতে থাকে। শরীর সারাক্ষণ না–ঘুম না–জাগরণের দ্বিধায় থাকে। অনিদ্রা এক দিনে যেমন হয় না, তেমনি প্রাকৃতিকভাবে এর থেকে বের হতেও সময় লাগে। এসবের সমাধান থাকবে ধারাবাহিকভাবে।